নির্বাচন কর্মকর্তা ও পুলিশের সহাতায় পাসপোর্ট পেয়েছে ১৩ রোহিঙ্গা

কক্সবাজারে এক ওয়ার্ডেই বাংলাদেশি বনেছেন দুই শতাধিক রোহিঙ্গা!

মনতোষ বেদজ্ঞ •

রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে সহযোগীতা করার অভিযোগে কক্সবাজারের সাবেক জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, পুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার ৩ জন র্র্কমকর্তা ও ১৩ জন ‘রোহিঙ্গা’সহ মোট ১৭ জনকে আসামী করে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

বৃহস্পতিবার দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর উপসহকারী পরিচালক মো: শরীফ উদ্দিন বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন।

মামলায় অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন কক্সবাজারের সাবেক জেলা নির্বাচন অফিসার ও বর্তমানে কুমিল্লা আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো: মোজাম্মেল হোসেন, কক্সবাজার জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক ও বর্তমানে রঙপুর ডিআইজি অফিসের পুলিশ পরিদর্শক প্রভাষ চন্দ্র ধর, কক্সবাজার জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক পরিদর্শক, বর্তমানে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) মো: রুহুল আমিন ও কক্সবাজার জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক, বর্তমানে পটুয়াখালী কন্ট্রোল রুমের পুলিশ পরিদর্শক এসএম মিজানুর রহমান।

মামলার এজাহারে এই সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একে অপরের সহেযোগীতায় অসৎ উদ্দেশ্যে প্রতারণার আশ্রয়ে নিজেরা লাভবান হয়ে এবং অন্যকে অন্যায়ভাবে লাভবান করে অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছে।

দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কারযালয়-২ এর উপসহকারী পরিচালক মো: শরীফ উদ্দিন জানিয়েছেন, অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কক্সবাজার জেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের দুই শতাধিক ব্যক্তি মিয়ানমারের নাগরিক হয়েও সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও সরকারি বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের অবৈধ সহযোগীতায় জাতীয়তা সনদপত্র, জন্ম নিবন্ধন সনদ, ভূমিহীন প্রত্যয়ন পত্র, স্কুলের প্রত্যয়ন পত্র, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত, স্মার্ট কার্ড এবং বাংলাদেশী পাসপোর্ট পেয়েছেন।

এমনকি তারা অনেকেই স্বপরিবারে প্রবাসে আছেন। তাদের অনেকেই ভূয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে প্রতারণার আশ্রয়ে অবৈধ উপায়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনহীন ল্যাপট এর মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এমনকি বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের তারা তাদের পরিবারের সদস্য দেখিয়ে একে অপরের সহযোগিতায় বাংলাদেশী নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করেছেন। পরবর্তীতে দুদকের অনুসন্ধান চলাকালে কক্সবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয়ের বিশেষ শাখা কর্তৃক অভিযুক্ত রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট বাতিলেরও সুপারিশ করা হয়েছে।

মামলার এজাহারে বরা হয়েছে, কক্সবাজার সদর উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের অন্তর্গত এলাকাটি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। সেখানকার রোহিঙ্গারা সরকারি খাস জমি ও বন বিভাগের জমি দখল করে তারা বানাচ্ছেন আলিশান বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট ও অন্যান্য স্থাপনা।

যেভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পায় রোহিঙ্গারাঃ কক্সবাজার সদর উপজেলার ইসলামাবাদের আউলিয়াবাদ গ্রামের বাসিন্দা হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট আছে মো. তৈয়ব (৩৫) এর। তৈয়ব এর দশ ভাই ও দুই বোন। পাঁচ ভাই বর্তমানে সৌদি প্রবাসী। ওমরাহ ভিসা নিয়ে তারা প্রবাসে গেছেন।

দুদক অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে বাংলাদেশী পরিচয়ে বসবাস করলেও তিনি আসলে মিয়ানমারের নাগরিক। তার মত অনেকেই মিয়ানমারের নাগরিক হয়েও সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও সরকারি বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের অবৈধ সহযোগীতায় জাতীয়তা সনদপত্র, জন্ম নিবন্ধন সনদ, ভূমিহীন প্রত্যয়ন পত্র, স্কুলের প্রত্যয়ন পত্র, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত, স্মার্ট কার্ড এবং বাংলাদেশী পাসপোর্ট পেয়েছেন।

দুদক অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে রোহিঙ্গা হয়েও জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট পেয়েছেন একই পরিবারের সদস্য মোহাম্মদ ওয়ায়েস, মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, মোহাম্মদ রহিম, আব্দুর রহমান, আব্দুস শাকুর, এবং একই গ্রামের নুর হাবিবা, আমাতুর রহিম, আসমাউল হুসনা, আমাতুর রহমান, নুর হামিদা, মোহাম্মদ ওসামা, হাফেজ নুরুল আলম। তাদের মধ্যে আব্দুস শাকুর বর্তমানে চট্টগ্রামের চাঁদগাঁওতে থাকেন, নুর হামিদা থাকেন কক্সবাজার পৌরসভার পূর্ব নতুন বাহারছড়ায়।

দুদক সূত্র জানায়, ইসলামাদের ৮ রোহিঙ্গা যথাক্রমে আমাতুর রহমান, মোহাম্মদ ওসামা, হাফেজ নুরুল আলম, আব্দুস শাকুর, আবদুর রহমান, নুর হাবিবা ও নুর হামিদার পাসপোর্ট দেওয়ার জন্য জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার তৎকালীন পরিদর্শক এসএম মিজানুর রহমান অনুকূল পুলিশ প্র্রতিবেদন দেন। তার অনুকূল পুলিশ প্র্রতিবেদনটি যাচাই-বাছাই না করেই সাবেক বিশেষ শাখার সাবেক ডিআইও-১ প্রভাষ চন্দ্র ধর পুলিশ সুপারের কাছে প্রেরণ করেন। এর প্রেক্ষিতে তারা পাসপোর্ট পেয়ে যান।

পরবর্তীতে দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলে এই ৮ জনকে মিয়ানমারের নাগরিক এবং ৩৫/৪০ বছর পূর্বে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে মর্মে ইস্যুকৃত পাসপোর্টগুলো বাতিল করার জন্য প্রতিকূল প্রতিবেদন প্রেরণ করা হয় বিশেষ শাখা থেকে। অপরদিকে মো. তৈয়ব জালাল ও আমাতুর রহিমের পাসপোর্ট ইস্যু করার জন্য তাদের পক্ষে জেলা বিশেষ শাখার তৎকালীন পরিদর্শক মোঃ রুহুল আমিন মতামত প্রদান করলে কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে তাদের পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়।

 

পরবর্তীতে দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলে মো. রুহুল আমিন প্রত্যয়ন দেন এই দু’জন মিয়ানমারের নাগরিক এবং ৩৫/৪০ বছর পূর্বে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে বিধায় তাদের পাসপোর্ট বাতিল করা প্রয়োজন।

দুদকের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ইসলাবাদ ইউনিয়নের রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন বালাম বই, জাতীয়তা সনদপত্রের বালাম বই ইউনিয়ন পরিষদ থেকে গায়েব করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ইসলামাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুর ছিদ্দিক জানিয়েছেন অভিযুক্তদের জন্ম নিবন্ধন বই এর ৪টি পাতা পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি পুলিশ কর্মকর্তারা সরেজমিনে ভেরিফাই করলেই সহজে ধরা যেতো। কিন্তু তারা তা না করে অসৎ উদ্দেশ্যে এবং নিজেরা লাভবান হয়ে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট প্রদানের পক্ষে মতামত দিয়েছেন।

ইসলামাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুর ছিদ্দিক এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী আবুল কালাম আজাদ পাসপোর্ট আবেদন সত্যয়ন ও প্রত্যয়ন করেছেন।

ভোটার হওয়ার নথি গায়েবঃ দুদক অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, স্থানীয় একজন ব্যক্তি (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম গোপন রাখা হলো) ভোটার হওয়া এসব রোহিঙ্গার জাতীয় পরিচয়পত্র বাতিল করার জন্য একটি দরখাস্ত দেন। এর প্রেক্ষিতে তৎকালীন জেলা নির্বাচন অফিসার মো. মোজাম্মেল হোসেন অসৎ উদ্দেশ্যে অভিযুক্ত আসামীদের যোগসাজশে লাভবান হয়ে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন দেন।

ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘অভিযোগকারীর অভিযোগের বিষয়ে যথাযত সাক্ষ্য ও তথ্য-প্রমাণ না থাকায় অপরদিকে বিবাদীদের পক্ষে শক্তিশালী বৈধ কাগজপত্র, তথ্য, প্রমাণ ও সাক্ষী থাকায় প্রতীয়মান হয় যে বিবাদীগণ প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশী নাগরিক।

তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র বৈধ।’ অথচ অভিযুক্তদের জন্ম নিবন্ধন সনদের বালাম বই, জাতীয়তা সনদপত্রের মুড়ি বই না। এমনকি তাদের ভোটার নিবন্ধন ফরম-২ সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসে সংরক্ষিত নেই অর্থাৎ গায়েব করে ফেলা হয়েছে। তাদের অধিকাংশই নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ল্যাপটপ ছাড়াই অসম্পূর্ণ ফরম-২ ব্যবহার করে ভোটার হয়েছেন। মো. তৈয়ব, মোহাম্মদ ওয়ায়েস, মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, মোহাম্মদ রহিম, আবদুর রহমান, আব্দুস শাকুর, নুর হাবিবা, আসমাউল হুসনা, আমাতুর রহমান, নুর হামিদা, মোহাম্মদ ওসামা ও হাফেজ নুরুল আলমের পাসপোর্টের আবেদন ও সংলগ্নীসমূহ পর্যালোচনা ও সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায় তারা সবাই রোহিঙ্গা।

 

কিন্তু ইসলামাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুর ছিদ্দিক উদ্দেশ্যে তাদের জাতীয়তা সনদপত্র ও জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র করে এবং নিবন্ধন বালাম বই গায়েব করে অর্পিতত ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজে লাভবান হয়েছেন।